ঢেঁকি
ঢেঁকি ধান ভানা বা শস্য কোটার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রবিশেষ। প্রাচীন কাল থেকে ভারত উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। ধরা হয় ঢেঁকি শব্দটি এক্কেবারে বাংলা শব্দ।ঢেঁকি প্রধানত ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বানানো কাঠের তৈরি কল বিশেষ। গ্রামাঞ্চলে চাল ও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। সাধারণত ঢেঁকিতে প্রায় ছয় ফুট লম্বা এবং ছয় ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট একটি কাঠের ধর থাকে। মেঝে থেকে প্রায় ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় ধরের একেবারে সামনে ২ ফুট লম্বা একটি গোল কাঠ যাকে মোনা বলা হয় ও দুটি খুঁটির ভিতর দিয়ে একটি ছোট হুড়কা থাকে। এই হুড়কার উপরই ধড়টি ওঠানামা করে। ঢেঁকি পা ও হাতের দ্বারা চালিত গ্রামীণ যন্ত্র বিশেষ। এর দ্বারা ধান ভেনে চাল বানানো হয়। প্রয়োজনে চাল থেকে গুঁড়া বানানো হয়। ফসলের সঙ্গে ঢেঁকির সম্পর্ক দিয়ে সূচিত হয়েছিল প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস। ঢেঁকির সঙ্গে নারীর সম্পর্ক নিবিড়। কারণ ঢেঁকি পরিচালনা করে নারীরা। এটি চালানোর জন্য সাধারণত তিনজন নারীর অংশ গ্রহণ প্রয়োজন হয়। দুজনে খানিকটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেয়। অন্যজন মাটিতে বসে মুষলের নীচে ধান বা চাল ওলোট পালট করে দেয়। যাতে ধানের খোলস ভেঙে চাল বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশের অনেক গ্রামে এমন সংস্কার বা রীতি প্রচলিত ছিল যে, নতুন ধান প্রথমে মেশিনে না ভাঙিয়ে ঢেঁকিতে ভানা হত। এর পরে সমস্ত ধান চাল করার জন্য মেশিনে নিয়ে যাওয়া হত। এক সময় বাংলার গ্রামগুলো নতুন ফসল তোলার পরে ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো। প্রতিটি গৃহাস্ত বাড়িতে ঢেঁকি ঘর থাকত। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানভানে, বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হয়ে এলেও ঢেঁকি এখন আর ধানভানে না। জন্ম থেকে মৃত্যুর ব্যবধানে প্রতিটি মানুষ প্রতিটি কাজ খুব দ্রুত সমাধানের জন্য সাহায্য নিচ্ছে যন্ত্রের। আর এ কারণেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের তালিকা থেকে ঢেঁকি ক্রমান্বয়ে বাদ পরে যাচ্ছে। যান্ত্রিক যুগের কলাকৌশলে ঢেঁকির অস্তিত্ব আজ বিলীন। এ উপমহাদেশের অনেক জাদুঘরে এখন ঢেঁকি দেখতে পাওয়া যায়। অগ্রহায়ণ মাসে ঢেঁকিতে নতুন ধান ভেঙে চাল করার ধুম পড়ে যেতো ঘরে ঘরে। ঢেঁকির ধুম ধুম শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোমর দুলিয়ে ঢেঁকিতে পা দিয়ে পাড় দিতো বাড়ীর মহিলারা। মধ্যরাত থেকে ভোররাত জেগে ধান ভানার মধ্যে বাংলার গৃহবধূরা কোথায় যেন একটা সুখের সন্ধান খুঁজে পেত। সর্বোপরি বলতে গেলে ঢেঁকি আজ যেন রূপকথার গল্পের মত হয়ে গেছে। অন্যদিকে কোথাও কোথাও আবার প্রদর্শনীর জন্য ঢেঁকিকে নিয়ে এসেছে শহরে, শোভা পাচ্ছে শোকেসে। কালের প্রভাবে ঢেঁকির ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা বিলুপ্ত হয়ে বিকল্প ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।
ষাট বা সত্তরের দশকে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই ঢেঁকি ছিল সংসারের অপরিহার্য একটি উপাদান। ঢেঁকি ছিলনা এমন বাড়ী বা এমন সংসার ছিলনা বললেই চলে। কৃষক মাঠ থেকে ধান কেটে আনতো। সেই ধান মাড়িয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে পাহার দিয়ে চাল বানানো হতো। তারপর সেই চালে রান্না হতো। তখন চাল ভাঙ্গানো এমন মেশিন ছিলনা বললেই চলে।ঢেঁকি ছিল প্রত্যেক সংসারের চলমান কার্যক্রমের অপরিহার্য একটি উপাদান। ঘরের বা সংসারের শোভা ছিল এই চিরচেনা ঢেঁকি। কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা যায় হারিয়ে গেছে।
গঠন
এক খণ্ড পাথরের চটান বা কাঠ খণ্ডে গর্ত খুঁড়ে মুষলের সাহায্যে শস্য কোটা হয়। মুষলটির মাথায় লোহার পাত জড়ানো থাকে। মুষলটি ৪/৫ হাত লম্বা একটি ভারী কাঠের আগায় জোড়া লাগিয়ে গর্ত বরাবর মাপে দুটি শক্ত খুঁটির উপর পুঁতে রাখা হয়।( মোটামুটি ছয় ফুট লম্বা ও ছয় ইঞ্চি চওড়া হয় পাটা, পিষে নেবার অংশটি মোটামুটি চোঙাকৃতি হয়ে থাকে )
ব্যবহার
(উপরের ভিডিওচিত্রটি জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের আলোকে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া; Video © Shuchanda)
শস্য কোটার জন্য ঢেঁকির গর্তে শস্য ঢেলে দিয়ে এক জন বা দু’জন ঢেঁকির গোড়ায় ক্রমাগত চাপ দেয়। অন্যদিকে মুষলের আঘাতের ফাঁকে ফাঁকে আরেক জন গর্তের কাছে বসে শস্যগুলো নাড়াতে থাকে।
নবান্ন উৎসবের সময় নতুন ধান এই ঢেঁকি দিয়ে ছাঁটাই করে গুঁড়ো করে তা দিয়ে তৈরি হয় পিঠে পুলি, চিঁড়ে ইত্যাদি।