১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এই সময়কাল ধরে বাংলাদেশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন, যারা দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
১. তাজউদ্দীন আহমদ (১৯৭১ – ১৯৭২)
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রথম সরকারের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের প্রধান নেতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা এবং দেশপ্রেম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ তৎক্ষণাৎ ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। ১০ এপ্রিল, মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এই সরকারকে “মুজিবনগর সরকার” বলা হয় এবং এটি মূলত কলকাতার ৮, থিয়েটার রোড থেকে পরিচালিত হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী একসঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করতেও তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য ছিল।
স্বাধীনতার পর
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, তাজউদ্দীন আহমদ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা চালান। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন, তবে কিছু রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে ১৯৭৪ সালে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবন
তাজউদ্দীন আহমদ একজন সৎ, নীতি-আদর্শসম্পন্ন এবং নির্লোভ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সহজ-সরল জীবনযাপন এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত মনোভাব তাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন জাতীয় নেতাকে বন্দী করা হয় এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা ইতিহাসে ‘জেলহত্যা দিবস’ নামে পরিচিত।
তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব, ত্যাগ এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্তকাল স্মরণীয় থাকবে।
২. শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২ – ১৯৭৫)
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের কারণে ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০ – ১৯৭৫), যিনি “বঙ্গবন্ধু” নামে পরিচিত, বাংলাদেশের স্থপতি এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন এবং তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব (১৯৭২ – ১৯৭৫)
সংবিধান রচনা:
১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়। এটি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের চারটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু জাতির ঐক্যবদ্ধ উন্নয়নের জন্য একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন এবং সাম্য নিশ্চিত করা হতো।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন:
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। দেশটির অর্থনীতি তখন বিপর্যস্ত ছিল, এবং তিনি কৃষি, শিল্প, এবং অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দেন। জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করে ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতকে রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট:
তবে ১৯৭৪ সালে দেশের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ আসে—একটি বিশাল দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংকট। খাদ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, এবং বেকারত্ব বেড়ে যায়, যা বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তবে এটি জনগণের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়।
বাকশাল গঠন:
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেন, যা একদলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। তিনি মনে করতেন যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা দেশকে উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে নিতে পারে। এই পদক্ষেপটি রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত ছিল এবং তার সমর্থকদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি করে।
হত্যা ও উত্তরাধিকার:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক নৃশংস সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। শেখ মুজিবের এই অকাল মৃত্যু দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা পরিবর্তিত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান শুধুমাত্র স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি নতুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সাংবিধানিক ভিত্তি এবং সামাজিক উন্নয়নের পথিকৃৎ ছিলেন।
৩. জিয়াউর রহমান (১৯৭৭ – ১৯৮১)
মুক্তিযুদ্ধের বীর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার শাসনামলে দেশের অর্থনীতি এবং সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে ভূমিকা রাখেন। জিয়া একটি উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন এবং বহুদলীয় রাজনীতি পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলে।
জিয়াউর রহমান (১৯৭৭ – ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের একজন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা, যিনি বাংলাদেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে উত্থান
জিয়াউর রহমান একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত এক অভ্যুত্থানের পর তিনি দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে ফিরে আসে, যা শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে একদলীয় শাসনের মধ্যে ছিল।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুত্থান
জিয়া বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করে। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেন, যার ফলে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অর্থনৈতিক সংস্কার
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন সংস্কার আনা হয়। তিনি কৃষি ও শিল্পখাতে উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদার অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেন। তার শাসনামলে দেশের রপ্তানি ও বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। বিশেষ করে, তার শাসনামলে গ্রামীণ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ইসলামিক চেতনা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে আরও সুসংহত করে। তিনি ইসলামী ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হন। তার শাসনামলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষ করে ওআইসি (Organisation of Islamic Cooperation) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে আরও শক্তিশালী হয়।
মৃত্যুবরণ
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময় জিয়াউর রহমান নিহত হন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর সংকট সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতার ভিত্তি তৈরি করে। জিয়ার উত্তরাধিকার নিয়ে আজও বাংলাদেশের রাজনীতি বিভক্ত।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ইসলামী ঐক্যের প্রবক্তা হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয়।
৪. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২ – ১৯৯০)
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সামরিক শাসনের অধীনে কিছু সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেন, তবে তার শাসনামল বিতর্কিত ছিল, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দমনের কারণে। ১৯৯০ সালে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় পার্টি (জাপা) প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় সক্রিয় ছিলেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, বিশেষ করে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে।
এই দুই নেতার শাসন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তৈরি করেছে, যেখানে সামরিক ও বেসামরিক শাসনের মধ্যে উত্তাল সময় দেখা যায়।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি দেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং তার শাসনকাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল।
ক্ষমতায় আগমন
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ, সেনাপ্রধান এরশাদ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন এবং সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি নিজেকে চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং পরে রাষ্ট্রপতি হন। এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে দমন করেছিল, যা তার শাসনামলে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে ওঠে।
শাসনামলের কার্যক্রম
এরশাদের শাসনামলে কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগ দেন। এরশাদ গ্রামীণ উন্নয়ন ও বেকারত্ব নিরসনের জন্য কিছু সামাজিক প্রকল্প চালু করেন, যা তাকে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে।
তাছাড়া, তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন, যা দেশের সংবিধান ও ধর্মীয় রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আনে। এই সিদ্ধান্ত তার জনপ্রিয়তা বাড়ালেও, তা সমাজে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়।
রাজনৈতিক আন্দোলন ও পতন
যদিও এরশাদ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়নমূলক উদ্যোগ নেন, তার শাসন ছিল দমনমূলক ও স্বৈরাচারী। তার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ, এবং সুশীল সমাজের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। তার শাসনের শেষ দিকে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়।
১৯৯০ সালে জনমতের চাপে এবং দেশব্যাপী গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পদত্যাগের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, এবং পরে ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী জীবন
পদত্যাগের পরেও, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টি (জাপা) গঠন করেন এবং বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি কখনও বিরোধীদলীয় নেতা, আবার কখনও সরকারের অংশ হিসেবে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু ২০১৯ সালে হয়, তবে তার প্রভাব এবং উত্তরাধিকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে থেকে গেছে।
এরশাদের শাসনামল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে সামরিক শাসনের বিপরীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্থান ঘটে।
৫. খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা
দীর্ঘমেয়াদি দুই নারী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ স্থান অর্জন করেছেন। বিএনপির খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছেন এবং দেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। শেখ হাসিনা বর্তমানে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন এবং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
১৯৭১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা দেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দেশকে একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।
খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন এবং দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন।
খালেদা জিয়ার শাসনামলকে অর্থনৈতিক সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন হিসাবে দেখা হয়। তবে তার শাসনকালে বিরোধী দল দমন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিযোগও ওঠে। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও মামলার কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। বর্তমানে তিনি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে আছেন, যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিছুটা শিথিলতা পেয়েছেন।
শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এবং ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানা প্রকল্প গ্রহণ।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। তবে, বিরোধী দল দমনের অভিযোগ এবং বাকস্বাধীনতার সংকোচনের সমালোচনাও রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল বিপুল বিজয় অর্জন করে, তবে বিরোধীরা নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বলে স্বীকার করেনি।
দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। দুই নেত্রীর শাসনকাল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে উভয়ের শাসনকালে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় সহিংসতা বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
৬. ড. মুহাম্মদ ইউনুস
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এই বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০২৪ সালে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, ড. ইউনুসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের পর এই পরিবর্তন আসে।
ড. ইউনুস, যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য। তিনি বর্তমানে নতুন নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সাথে আলোচনা করছেন। তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সুশীল সমাজের সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপন।
ড. ইউনুসের এই ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেখানে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তার অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।